পৃথিবী, আমাদের পৃথিবী, আজ বিপন্ন। বৃষ্টির মতো কখনো বর্ষণ হতে পারে, আবার কখনো অঝোর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে। নদী, সমুদ্র, পাহাড় সবকিছু যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে, আমরা যারা মানুষের এক নৃশংস জীবন্ত স্মৃতির মতো, তারা কি উপলব্ধি করি এই ক্ষতি? আমরা কি বুঝতে পারি যে, আমাদের ভবিষ্যতের সুরক্ষা তাম্বুলের ছোঁয়া নয়, এক শুদ্ধ বাতাসের মতো যা শুধুমাত্র সঠিক শিক্ষা থেকেই আসবে ?
ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন হচ্ছে সেই শিক্ষা, যা আমাদের দেখায় কেবল
তথ্য নয়, একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করার, প্রকৃতির ভাষা শোনার এবং সেই
ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানার। এটি সেই শিক্ষা, যা কেবল সমুদ্রের ঢেউয়ের গতিপথ বোঝাতে
পারে না, বরং আমাদের অন্তরে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা
ও সহানুভূতির বীজ বুনে দেয়। এখানে, শেখানো হয় শুধু বিজ্ঞান ও গণনা নয়, শেখানো হয় এক নতুন
মানবিক দৃষ্টি যা শুধু বেঁচে থাকার নয়, পরিবেশকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গড়ে তোলার
পদ্ধতি।
এই শিক্ষা কোনো কপোটিকা
নয় এটি একটি আঙিনায় ঘুরে বেড়ানো, একটি
গানের মৃদু সুর, একটি গাছের ছায়ার মতো। ক্লাইমেট স্মার্ট শিক্ষা আমাদের শেখায়, শুধু নিজেদের জন্য নয়, সারা পৃথিবী, পরিবেশ এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও পথ
তৈরি করতে হবে।
এটি কোনো একক গন্তব্য নয়
এটি একটি যাত্রা, যেখানে শিক্ষাই আমাদের পাথেয়।
আজ, যখন আমাদের পৃথিবী বিপন্ন, তখন এই যাত্রা যেন আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। আমাদের
প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ এগুলিই আমাদের ভবিষ্যত
রচনা করবে। ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন তাই এক নতুন বাস্তবতা, এক নতুন আশার নাম।
🔰ক্লাইমেট স্মার্টএডুকেশন
একটি নতুন
ধারার শিক্ষাগত পদ্ধতি, যার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের
প্রভাব মোকাবিলা করা এবং শিক্ষার্থীদের জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা। এটি এমন
একটি সমন্বিত উদ্যোগ যা শিক্ষাব্যবস্থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল,
অভিযোজনক্ষম ও টেকসই করে তোলে।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য
💹জলবায়ুবিষয়ক জ্ঞান প্রদান,
শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ,
প্রভাব ও সমাধান সম্পর্কে
সচেতন করা, জলবায়ু অভিযোজন
ও প্রশমন শিখানো,
💹অভিযোজন ও প্রশমনের কৌশল
কীভাবে স্থানীয়ভাবে অভিযোজন ও প্রশমনের
কৌশল গ্রহণ করা যায় (যেমন: জল-সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব
চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি)।
💹জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো
বিদ্যালয়ভিত্তিক
জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, স্কুল বিল্ডিং ও
পরিবেশকে জলবায়ু সহনশীলভাবে তৈরি বা রূপান্তর করা (যেমন: বন্যা সহনশীল স্কুল ভবন,
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থা)।
💹শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি
পাঠ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
অন্তর্ভুক্ত করা।
💹কমিউনিটি সম্পৃক্ততা
শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে জলবায়ু
বিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা। >জেন্ডার ও
অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, নারী, শিশু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সবার জন্য জলবায়ু বিষয়ক
শিক্ষা নিশ্চিত করা।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশনের লক্ষ্য
শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য
প্রস্তুত করা, দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তোলা, স্কুলভিত্তিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস , টেকসই উন্নয়নের জন্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি, বিদ্যালয়ে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ
কর্মসূচি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও জলবায়ু বিষয়ক ক্লাব গঠন করা । শিক্ষার্থীদের দিয়ে “জলবায়ু অ্যাকশন প্ল্যান” তৈরি করানো এবং বাস্তবায়নে যথাযথ স্বমন্বিত সহযোগিতা করা।
🔰জলবায়ু পরিবর্তন ওশিক্ষার আন্তঃসম্পর্ক
জলবায়ু পরিবর্তন বলতে পৃথিবীর গড়
তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনকে বোঝায়, যা প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও
প্রধানত মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের (যেমন: জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বন উজাড়, কার্বন ও
মিথেন গ্যাস নিঃসরণ) ফলে ঘটে থাকে। বৈজ্ঞানিকভাবে, এটি "গ্রিনহাউজ
প্রভাব"-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড , মিথেন , নাইট্রাস
অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে থেকে সূর্যের তাপ শোষণ করে পৃথিবীর
তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি
প্যানেল অনুযায়ী,
২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা পূর্ব শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি
সেলসিয়াস বেড়ে যাবে, যদি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।
🔰জলবায়ু পরিবর্তন শিক্ষাব্যবস্থার ঝুকি
জলবায়ু পরিবর্তন শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর
প্রেক্ষাপটে যেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। স্কুলে উপস্থিতি ও শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার, বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বহু স্কুল
ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথবা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে, পরিবারের আয়ের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হলে শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়,
ফলে বিদ্যালয়ে যাওয়া কমে যায়, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। শিক্ষা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়া, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়,
জলোচ্ছ্বাসে স্কুল ভবন ভেঙে পড়ে বা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
💂শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য
দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে বিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তাহীন পরিবেশ
শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। শিশুদের মানসিক
স্বাস্থ্য ও মনোযোগে প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিবার হারানো বা আশ্রয়হীনতার কারণে
শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও মনোযোগহীনতা তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই মানসিক চাপ
শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয়
এলাকার প্রায় ১৫০০-এর বেশি স্কুল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অনেক
শিশুই মাসের পর মাস বিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি।
কেন শিক্ষা
খাতকে জলবায়ু অভিযোজনের অংশ করতে হবে? জলবায়ু অভিযোজন বলতে বোঝায় এমন কৌশল ও
পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যা পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।
শিক্ষাব্যবস্থাকে অভিযোজনমুখী করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন, দক্ষ ও প্রস্তুত করতে হলে পাঠ্যক্রমে
জলবায়ুবিষয়ক জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। শিক্ষার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জীবনধারা, টেকসই কৃষি, জ্বালানি
ব্যবস্থাপনা, ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব।
🌀স্কুলের ডিআরআর (ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন)
স্কুলের ডিআরআর (ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন)
কার্যক্রম শিশুদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলে।
এতে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়কেও সচেতন করতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থায়
জলবায়ু-সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে নারীরা,
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী শিশুরা দুর্যোগকালীন সহায়তা ও নিরাপত্তা লাভে
সক্ষম হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও
শিক্ষা একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি কার্যকর ক্লাইমেট স্মার্ট সমাজ
গঠনে শিক্ষাব্যবস্থাকে অভিযোজনমুখী, সহনশীল এবং কার্যকর
করে তুলতে হবে। এজন্য শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি, সচেতনতা ও টেকসই চিন্তাভাবনার বিকাশ যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন ধারণা, মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য
ক্লাইমেট
স্মার্ট এডুকেশন (জলবায়ু স্মার্ট শিক্ষা) হলো এমন একটি শিক্ষাগত পদ্ধতি যা শিক্ষার্থীদের জলবায়ু
পরিবর্তনের প্রভাব, এর প্রতিক্রিয়া, অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশল সম্পর্কে সচেতন করে
তোলে এবং শিক্ষা খাতকে জলবায়ু-সহনশীল করে গড়ে তোলে। এটি শুধু শিক্ষার বিষয়বস্তু
নয়, বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার একটি বিস্তৃত
রূপান্তর প্রক্রিয়া। সহজভাবে বললে,
ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন মানে হলো এমন এক
শিক্ষা ব্যবস্থা যা জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়াতে
সক্ষম, পরিবেশবান্ধব আচরণ গড়ে তোলে, এবং শিক্ষা খাতকে
দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত করে।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশনের মূল উপাদান
ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশনকে কার্যকরভাবে
বাস্তবায়নের জন্য চারটি প্রধান উপাদান বিশেস গুরুত্বপূর্ণ: শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যবিষয়বস্তু; পাঠ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞান,
পরিবেশ রক্ষা, নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। শিশুদের বয়স উপযোগী উপায়ে পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক জ্ঞান প্রদান। কল্পনা, সমস্যা সমাধান ও
সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা গড়ে তোলার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা।
🌴জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো "গ্রিন
ক্যাম্পাস"
স্কুল বিল্ডিংকে দুর্যোগ প্রতিরোধী (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা,
ভূমিকম্প) করে তোলা। বৃষ্টির
পানি সংরক্ষণ, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ব্যবস্থা চালু করা। বিদ্যালয়কে
“"গ্রিন ক্যাম্পাস" হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষক
প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি শিক্ষকদের জলবায়ু বিষয়ক প্রশিক্ষণ
প্রদান। টিচিং মেথডে
পরিবেশগত চেতনা ও সমস্যা নিরসনের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা। শিক্ষকদের নেতৃত্বে পরিবেশ ক্লাব
গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনা। শিক্ষা
পরিচালনা ও নীতিগত নির্দেশনা ; জাতীয় শিক্ষানীতিতে জলবায়ু
অভিযোজন ও টেকসই শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি। দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয় পরিকল্পনা (স্কুল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা)।স্কুল, কমিউনিটি ও স্থানীয় সরকার
সমন্বিত পরিকল্পনা।
💔নৈতিকতা ও দক্ষতা
ক্লাইমেট
স্মার্ট এডুকেশন হলো
সময়োপযোগী, কার্যকর ও ভবিষ্যতমুখী একটি শিক্ষাগত রূপান্তর। এটি শুধু পরিবেশ
সম্পর্কে জানায় না, বরং শিক্ষার্থীদের পরিবেশের জন্য কাজ করার নৈতিকতা ও দক্ষতা
গড়ে তোলে। অন্যান্য শিক্ষা মডেলের তুলনায় এটি অধিক সমন্বিত, ব্যবহারিক ও
অন্তর্ভুক্তিমূলক। শিক্ষা খাতকে জলবায়ু সহনশীল করার
জন্য এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ
যদিও উদ্যোগ অনেক, তবুও ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন বাস্তবায়নে
কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে: জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। বাজেটে শিক্ষা খাতে জলবায়ু অভিযোজন বরাদ্দ
অপ্রতুল। অধিকাংশ
শিক্ষক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিষয়গুলো শেখাতে প্রস্তুত নন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক সংখ্যায় খুবই কম। অনেক অভিভাবক ও কমিউনিটি সদস্য শিক্ষাকে
এখনো শুধুই “পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান” হিসেবে দেখে। জলবায়ু পরিবর্তনকে শিক্ষার অংশ হিসেবে
নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি কম। শিক্ষা, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বিভাগের মধ্যে সমন্বয় দুর্বল। অনেক নীতিমালা থাকলেও তা মাঠ পর্যায়ে
প্রয়োগ হয় না।
🔰জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষাব্যবস্থারঅবস্থা
বাংলাদেশের উপকূলীয়,
নদীভাঙনপ্রবণ ও পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে। কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সমস্যা এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন, উপকূলীয় অঞ্চল (সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী): ঘূর্ণিঝড়,
জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক শিশু দীর্ঘ সময় শিক্ষার বাইরে থাকে।
নদীভাঙনপ্রবণ
অঞ্চল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, শরীয়তপুর): স্কুল
নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, স্থায়ী স্থাপনার অভাব। শিশুদের স্কুলে যাওয়া ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। হাওর ও পাহাড়ি
এলাকা: বর্ষায় পানিবন্দি হওয়া, পাহাড়ধসে
স্কুল ধ্বংস হওয়া ইত্যাদি। পড়াশোনায়
দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা শিক্ষার মান কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে ক্লাইমেট
স্মার্ট এডুকেশন
বাস্তবায়নে ইতিবাচক , তবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে এখনো বড় বড়
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে শক্তিশালী সমন্বয়, বাজেট বৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় কমিউনিটির সম্পৃক্ততা এই প্রয়াসকে
সফল করতে পারে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিশেষ করে শিশুদের জন্য শিক্ষা নিরাপদ ও
সহনশীল করতে হবে ,যাতে তারা
ভবিষ্যতে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে মোকাবিলা করতে শিক্ষাব্যবস্থাকে অভিযোজনক্ষম ও টেকসই করে গড়ে তোলার জন্য
শুধু নীতিমালা
নয়, বাস্তবভিত্তিক কৌশল, উদ্ভাবন ও গবেষনা অত্যন্ত জরুরী।
🔰শিক্ষাক্রমে জলবায়ুঅন্তর্ভুক্তিকরণ কৌশল
সকল স্তরের শিক্ষাক্রমে বয়সভিত্তিক জলবায়ু
শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা। “প্রাকৃতিক
দুর্যোগ”, “নবায়নযোগ্য শক্তি”, “জলবায়ু ন্যায্যতা”,
“টেকসই জীবনধারা” বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্তি। বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিবেশ শিক্ষা,
সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে জলবায়ু ন্যায্যতা ও মানবিক প্রভাব বিষয়গুলোর
সংমিশ্রণ।বাস্তবভিত্তিক শেখা (জলবায়ু পরীক্ষা, বৃষ্টির পানি পরিমাপ, বাগান তৈরি)।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে শিশুদের
উপযোগী ডিজিটাল গেম, অ্যানিমেশন ও ইন্টারেক্টিভ লার্নিং টুল। শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক
পরিবেশ আন্দোলন/ক্লাব গঠন; প্রতিটি স্কুলে ‘পরিবেশ ও জলবায়ু ক্লাব’
গঠন। নিয়মিত
সচেতনতামূলক কার্যক্রম: দেয়ালিকা, বৃক্ষরোপণ, র্যালি, পোস্টার মেকিং, ক্লাইমেট লিডার তৈরি শিক্ষার্থী প্রতিনিধি যারা স্কুল ও
কমিউনিটিতে পরিবেশগত সিদ্ধান্তে অংশ নেবে। ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’, ‘দুর্যোগ প্রস্তুতি
দিবস’’ স্কুলভিত্তিক উদযাপন করে সচেতনতা তৈরি। স্কুল ব্যবস্থাপনায় অভিভাবক, স্থানীয়
প্রতিনিধি, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে আগ্রহী সদস্যদের যুক্ত
করা। বন্যা,
ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা মোকাবেলায় সচেতনতা এবং প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যৌথভাবে বাগান
পরিচালনা, যেখানে পানি সংরক্ষণ ও টেকসই চাষাবাদ চর্চা করা হয়। দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যালয়
ব্যবহারের মাধ্যমে স্কুলের প্রতি কমিউনিটির আস্থা
বাড়ানো।
🔰ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন ও পাঠদান
শুধু তাত্ত্বিক পাঠদানে সীমাবদ্ধ না রেখে
একে বাস্তব ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজনযোগ্য করে তোলার জন্য এই কৌশল ও
উদ্যোগগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে অবকাঠামো, প্রযুক্তি,
শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ ও
কমিউনিটি সংযোগ সবগুলো
মিলিয়ে একটি জলবায়ু সহনশীল শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই
রূপান্তর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা নয়, বরং পরিবর্তনের
জন্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও তৈরি করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রতিনিয়ত জটিলতর
হচ্ছে। আমাদের মতো
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে ভবিষ্যতের
জন্য সুসংহত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
🔰সভ্যতার সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের করাল
ছায়া আজ নিছক পরিবেশগত সংকট নয় এ এক সভ্যতার অস্তিত্ব সংকট। এর
অভিঘাতে কাঁপছে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, কাঁপছে স্কুলের ছাউনি, শিশুর চোখে জমেছে
উদ্বেগের মেঘ। অথচ এ আঁধারের মধ্যেই আলো ছড়ায় একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা শিক্ষা।
ক্লাইমেট স্মার্ট
এডুকেশন আমাদের শেখায় কেবল বাতাস ও সমুদ্রের রসায়ন নয় শেখায় সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ, পরিবর্তনের স্পৃহা। এটি জ্ঞানের সেই প্রবাহ, যা
শিশুর হৃদয়ে আশ্রয় নেয় নদীর মত, প্রতিটি প্রশ্নের চরণে ছুঁয়ে যায় প্রকৃতির আদিম
ছন্দ। এই শিক্ষা গড়ে তোলে এমন
এক প্রজন্ম, যারা দুর্যোগের মধ্যে শুধু বাঁচতে চায় না, তারা চায় জয় করতে, গড়ে তুলতে নতুন পৃথিবী, যেখানে
মাটির গন্ধ হারায় না, জল চোখে জল এনে দেয় না, আর শিশুর হেসে উঠা থেমে থাকে না
বন্যার ঘূর্ণিতে।
এখানে শিক্ষক হয়ে ওঠেন
বৃষ্টির ব্যাখ্যাকার, পাঠ্যপুস্তক নয়, হয়ে ওঠে ধানের শীষ, বৃক্ষের কণ্ঠ, নদীর
আর্তনাদ। শ্রেণিকক্ষ সীমাবদ্ধ থাকে না দেয়ালের চারপাশে, বরং বিস্তৃত হয় আকাশ ও পাখির ডানায়। শিশু জানে, সে কেবল পড়ালেখার জন্য বিদ্যালয়ে
যায় না সে যায় পৃথিবীকে
ভালোবাসতে শেখার জন্য।